পরিচিতি
এক সময়ের অপরিচিত কাঁটা বেগুন গাছ, যা গ্রামের পথে-ঘাটে পরিচর্যা ছাড়াই বেড়ে উঠত, আজ তা নওগাঁর কৃষক ফারুক হোসেনের হাত ধরে নতুন পরিচিতি পেয়েছে। তিনি গ্রাফটিং (কাটিং কলম) পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। এই আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে ফারুক হোসেন যেমন অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছেন, তেমনই বদলগাছী উপজেলায় কৃষকদের জন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছেন।
গ্রাফটিং পদ্ধতির পরিচিতি
কাঁটা বেগুন গাছকে কাজে লাগিয়ে গ্রাফটিং পদ্ধতিতে টমেটো চাষ করার ধারণাটি প্রথমে আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে, কিন্তু এটি এখন বাস্তব এবং সফলতা অর্জন করছে। বদলগাছী উপজেলার স্থানীয় এনজিও ‘মৌসুমি’, পিকেএসএফ-এর সহায়তায় প্রথম এই পদ্ধতিটি কৃষকদের মাঝে চালু করে। গ্রাফটিং পদ্ধতিতে বেগুন গাছের মজবুত শিকড় ও কান্ড ব্যবহার করে তার ওপর টমেটোর চারা গ্রাফট করে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় টমেটো গাছটি বেগুন গাছের মতোই মজবুত হয়, এবং এটি রোগবালাই প্রতিরোধেও সক্ষম।
ফারুক হোসেনের সাফল্যের গল্প
নওগাঁর বদলাগাছী উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামের কৃষক ফারুক হোসেন প্রথমবারের মতো এই পদ্ধতিতে টমেটো চাষ করে তার জমিতে সাফল্যের ছাপ ফেলেছেন। তিনি স্থানীয় এনজিও ‘মৌসুমি’ থেকে চারা ও পরামর্শ নিয়ে টমেটো চাষ শুরু করেন। ফারুক জানান, ৭ শতক জমিতে চাষ করতে তার খরচ হয় ১২ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকার টমেটো বিক্রি হয়েছে এবং জমিতে যে টমেটো রয়েছে, তা থেকে তিনি আশা করছেন আরও ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা আয় করতে পারবেন। খরচ বাদে, এই চাষ থেকে তার নিট লাভ হবে প্রায় ২৫ হাজার টাকা।
কৃষি কর্মকর্তাদের মন্তব্য
মৌসুমী কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, “পিকেএসএফ-এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় সমন্বিত কৃষি ইউনিট স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা ‘মৌসুমি’ বেগুন গাছে টমেটো চাষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করছে। ৭ শতক জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করতে ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তবে পরের বছর ব্যয় কমে যাবে। এই পদ্ধতিতে টমেটো চাষে বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে ছাউনি ও বেড়া তৈরি করতে হয়। সাধারণত শীতকালীন টমেটো চাষে এগুলো লাগে না। গাছে ফুল এলে দুই দিন পর পর হরমোন ছিটাতে হয়। এ পদ্ধতিতে ঢলে পড়া রোগ হয় না এবং সার ও কীটনাশক খরচ কম লাগে। তবে দ্বিতীয় বছর ছাউনি দেওয়ার জন্য বাঁশ কিনতে হয় না এবং বেড়া দিতে হয় না। মূলত আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে আসছি। কৃষকরা যেন কম সময়ে, কম পরিশ্রমে ও স্বল্প খরচে বেশি লাভ করতে পারে সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।”
আরও পড়ুন : সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা: জমি বেদখলের অভিযোগে আলোড়ন
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
বদলগাছী উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা সাবাব ফারহান বলেন, “কয়েক বছর আগেও এলাকার কৃষকরা জানতেন না যে, বেগুন গাছে টমেটো চাষ করা সম্ভব। কিন্তু এই চাষ পদ্ধতি সহজ এবং ফলন ভালো হয়। তাছাড়া রোগবালাই কম হয়। ফলে কৃষকদের মধ্যে এই পদ্ধতির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। টমেটোর ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকদের মধ্যে এই চাষের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা কৃষকদের কৃষি বিভাগ থেকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করছি এবং ভবিষ্যতে আরও কৃষককে এই পদ্ধতিতে চাষ করতে উদ্বুদ্ধ করার পরিকল্পনা করছি।”
সাবাব ফারহান আরও বলেন, “বদলগাছী উপজেলায় স্থানীয় এনজিও ‘মৌসুমি’ প্রথম এই টমেটো চাষ শুরু করেছে। তারা চারা, উপকরণ ও পরামর্শ প্রদান করছে। আগামীতে ব্যাপকভাবে এই এলাকায় কৃষকরা গ্রাফটিং (কাটিং কলম) পদ্ধতিতে টমেটো চাষ শুরু করবেন।”
সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
গ্রাফটিং পদ্ধতিতে টমেটো চাষের প্রধান সুবিধা হলো এটি কম খরচে এবং কম সময়ে বেশি ফলন দেয়। কৃষকরা ফসল থেকে ভালো দাম পেয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হন। তবে, এই পদ্ধতিতে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যেমন শুরুর দিকে বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে ছাউনি ও বেড়া তৈরি করতে কিছুটা খরচ বেশি হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এই ব্যয় অনেকটাই কমে আসে।
গ্রাফটিং পদ্ধতির টমেটো চাষ বদলগাছীসহ নওগাঁর বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের মধ্যে একটি নতুন আশা জাগিয়েছে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগে ফসল উৎপাদনে নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। ফারুক হোসেনের সফলতা আরও অনেক কৃষককে অনুপ্রাণিত করবে এবং তারা এই নতুন পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করতে উৎসাহিত হবেন।
বেগুন গাছে টমেটো চাষের এই উদ্ভাবনী পদ্ধতি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কৃষক ফারুক হোসেনের সাফল্যগাথা শুধু এই অঞ্চলের কৃষকদের জন্য নয়, বরং সারাদেশের কৃষকদের জন্যও একটি উদাহরণ হয়ে উঠেছে। কম সময়ে, কম খরচে এবং কম পরিশ্রমে বেশি লাভের এই চাষ পদ্ধতি ভবিষ্যতে কৃষিক্ষেত্রে আরও বিস্তৃত হতে পারে। এর মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে এবং দেশের কৃষি অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
/ s24online