বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি মার্কিন সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, রিজার্ভ সংকট সামাল দিতে এবং আমদানি ব্যয় মেটাতে চীনের কাছে ৫ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের অর্থাৎ ৫০০ কোটি ইউয়ান ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। গভর্নর তালুকদার বলেন, “চীনা মুদ্রা ইউয়ানে ঋণ গ্রহণ করা হবে। রিজার্ভ সংকট সামাল দেয়া ছাড়াও চীন থেকে পণ্য আমদানি ব্যয় মেটাতেও ঋণের অর্থের ব্যবহার করা হবে। তবে ঋণের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”
গভর্নর জানান, এখন পর্যন্ত দুপক্ষের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে কারিগরি আলোচনা হয়েছে এবং আগামী সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিং গেলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এদিকে, চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) ঢাকায় এক সাক্ষাৎকারে জানান, রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় চীনের কাছে বাংলাদেশ সহযোগিতা চেয়েছে। এটি প্রথমবারের মতো রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশ থেকে সহযোগিতা চেয়েছে। রাষ্ট্রদূত বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের মাধ্যমে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যেতে পারে।”
গভর্নর তালুকদার আরও বলেন, “চলতি বছর সেপ্টেম্বরের পর থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে। কয়েক মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার কমে আসবে। অন্যদিকে, ইউয়ান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অনুমোদিত মুদ্রা হওয়ায়, এই ঋণের ফলে রিজার্ভে চাপ কমে আসবে এবং চীনা পেমেন্ট নিষ্পত্তিও সহজ হবে।”
করোনা পরবর্তী সময় থেকে দেশের রিজার্ভ ক্রমাগত কমতে থাকে। এর মধ্যে শিপমেন্ট সংক্রান্ত জটিলতায় পোশাক খাতের রফতানি ১০ শতাংশ কমে যাওয়া এবং মূল্যস্ফীতির উচ্চহারের কারণে চাপ বাড়তে শুরু করে। গত বছর বাংলাদেশকে আইএমএফ ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন দিলেও এখন পর্যন্ত রফতানি খাত চাপের মধ্যে রয়েছে। ক্রমাগত রিজার্ভ কমার ফলে গত মে মাসে বাংলাদেশের ক্রেডিট স্কোর আরও কমিয়েছে ফিচ রেটিংস।
টাকার অবমূল্যায়ন রুখতে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্ধারণ প্রসঙ্গে গভর্নর তালুকদার বলেন, “আপাতত এই পদ্ধতিতে বাজারে ডলার অস্থিরতা অনেকটা কমে এসেছে। রিজার্ভ বাড়তে শুরু করলে এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ইতিবাচক পর্যায়ে গেলে বাজার ভিত্তিক ডলারের দাম নির্ধারণ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।”
দুবছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছেন আব্দুর রউফ। নিজের লক্ষ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দেশের ব্যাংকিং খাতকে ঢেলে সাজানোই প্রধান লক্ষ্য। বিশেষ করে খেলাপি ঋণের অনুপাত ৮ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে।
বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট গত কয়েক বছরে তীব্র হয়েছে। করোনা মহামারির পরে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন খাতে ব্যয় বেড়েছে। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে চাপের কারণে রিজার্ভে সংকট দেখা দিয়েছে।
গভর্নর তালুকদারের মতে, “এটি অস্থায়ী একটি সমস্যা, যা কয়েক মাসের মধ্যে সমাধান হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলে এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়লে রিজার্ভ সংকট কমবে।”
চীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার এবং দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে চীনের বিভিন্ন খাতে পণ্য আমদানি এবং রফতানি হয়ে থাকে। চীন থেকে ঋণ নিয়ে রিজার্ভ সংকট মোকাবিলা করার পরিকল্পনা প্রমাণ করে যে, দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
গভর্নর তালুকদারের মতে, “আমরা আশা করি, চীন থেকে ঋণ নিয়ে আমরা আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে পারব এবং দেশীয় শিল্প খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারব।”
বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট মোকাবেলায় চীনের কাছে ৫ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ইউয়ান ঋণের অনুরোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হতে পারে এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম সহজতর করতে পারে। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের এই উদ্যোগ দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা প্রদান করে।